ঢাকা, ১৫ নভেম্বর: যে কোনও ব্যস্ত কর্মদিবসে ঢাকার রাস্তায় বের হলেই বোঝা যায় দূষণ কত প্রকার ও কি কি। গাড়িঘোড়ার ধোঁয়া, এখানে সেখানে ডাস্টবিনের উপচে পড়া ময়লা আর ড্রেনের পানি- এগুলো মিলে বীভৎস এক অবস্থা তৈরি হয়। শুধু রাস্তাই নয়, রাজধানীর এমন আরেকটি জায়গা হলো হাজারীবাগ। ছোট্ট একটা জায়গায় দুই শতাধিক ট্যানারির পচা গন্ধে সেখানে টেকা দায়, আর তা থেকে আঁচ করা যায় দূষণের পরিমাণ। সুতরাং পৃথিবীব্যাপী দূষিত এলাকার তালিকায় এই এলাকার নাম যে চলে এসেছে তাতে আসলে অবাক হবার কিছু নেই। পৃথিবীর শীর্ষ দশ দূষিত এলাকার তালিকায় রয়েছে হাজারীবাগ। এ ছাড়াও রয়েছে রাশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার দুটি করে এলাকা।
শিল্পকারখানায় ঠাসা শহরতলি, বর্জ্য-শোধনাগার, নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার এলাকা- এসব এলাকায় যে দূষণ অনেক বেশি হবে সেটা বোঝাই যায়। এসব এলাকার দূষণের পরিমাপ করার পর তালিকা আকারে প্রকাশ করে নিউ ইয়র্কের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান Blacksmith Institute। এই তালিকায় থাকা এলাকাগুলোর মাঝে কোনটি বেশি দূষিত আর কোনটি কম দূষিত তা বলা হয়নি, তালিকাটি সাজানো হয়েছে বর্ণানুক্রমিক প্রক্রিয়ায়।
মাত্র ১০ টি এলাকার কথা এখানে বলা হলেও, দূষণের পরিমাণ শুধু এসব এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নয় বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফুলার। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে আছে শুধুমাত্র দূষণের কারণে। World Health Organization (WHO) এর হিসাব অনুযায়ী, ২৩ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে পরিবেশ দূষণ। ক্যান্সারের আশঙ্কা তো আছেই, দূষক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে ক্ষণস্থায়ী থেকে দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া, মানসিক সমস্যা, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা যেতে পারে। বিশেষত শিশুদের মাঝে এসব ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। আসুন দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর কোন এলাকাগুলো বেশি দূষিত।
আগবোগব্লোশি, ঘানা
পশ্চিম আফ্রিকার দ্বিতীয় ই-বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে ঘানার রাজধানী আক্রার এই এলাকায়। বিভিন্ন যন্ত্রের তারের প্লাস্টিক আবরণ পুড়িয়ে ভেতরের কপারের অংশ বের করা হয় এখানে, আর সেই প্রক্রিয়ায় বাতাস এবং মাটিতে রয়ে যায় প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিকর ধাতু। ধারণা করা হয়, এই দূষণ থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবন প্রভাবিত হয়।
চেরনোবিল, ইউক্রেইন
১৯৮৬ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ংকরতম নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার সাক্ষী এই অঞ্চল। হিরোশিমা-নাগাসাকি এই দুই শহরের দুই বোমা মিলিয়ে যতটা না তেজস্ক্রিয়তা তৈরি হয়েছিল, তার চাইতে ১০০ গুন বেশি তেজস্ক্রিয়তা তৈরি হয় এই এক অঞ্চলে। ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, বন্ধ্যাত্ব এবং জন্মকালীন জটিলতা ইত্যাদি দেখা যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে। এই দুর্ঘটনায় তৈরি তেজস্ক্রিয়তা বছরের পর বছর ধরে বেলারুশ, রাশিয়া এবং ইউক্রেইনের প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের ক্ষতি করে বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ৪,০০০ মানুষের থাইরয়েড ক্যান্সারের কারণ হিসেবেও একে চিহ্নিত করা হয়।
সিটারিয়াম নদী, ইন্দোনেশিয়া
প্রত্যক্ষভাবে ৫ লক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ৫ মিলিয়ন মানুষের ক্ষতি করে চলেছে পশ্চিম জাভার এই নদী। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের পর সীসা, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং লোহা জমা হয় রাসায়নিকভাবে দূষিত এই নদীতে যার মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি।
ঝারশিনস্ক, রাশিয়া
রাশিয়ার রাসায়নিক উৎপাদনের কেন্দ্র হল এই স্থান। ডাইঅক্সিন, ফেনল ইত্যাদি দূষক পদার্থে ভরে আছে এখানকার ভূগর্ভস্থ পানি। স্থানীয় অধিবাসীদের শরীর বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারে জর্জরিত। এখানকার পুরুষদের আয়ু মাত্র ৪২ এবং নারীদের ৪৭ বছর!
[su_box title=”হাজারীবাগ, বাংলাদেশ”]বস্তাপচা প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখানকার ট্যানারি থেকে আসা বর্জ্য শোধিত হয় না সঠিকভাবে। এ কারণে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রায় ২২ কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে এবং ক্ষতি করছে প্রায় ১.৬ লাখ মানুষের। এতে বিশেষ করে রয়েছে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে।[/su_box]
কাবওয়ে, জিম্বাবুয়ে
আফ্রিকার এই শহরে বছরের পর বছর ধরে খনি থেকে ওঠানো হয়েছে সীসা, যার ফলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে এখানকার বাসিন্দারা। ধারণা করা হয়, ৩ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করছে এই দূষণ। ২০০৬ সালে এখানকার শিশুদের রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা ছিল স্বাভাবিকের চাইতে ৫-১০ গুন বেশি!
কালিমান্তান, ইন্দোনেশিয়া
বোর্নিও দ্বীপের কালিমান্তান এবং অন্যান্য এলাকায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পারদের দূষণ। এর কারণ হলো স্বর্ণ উত্তোলন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুই লাখ পঁচিশ হাজার মানুষ।
মাতানযা নদী, আর্জেন্টিনা
প্রায় ১৫ হাজার কারখানার থেকে আসা বর্জ্য বয়ে নিয়ে যায় এই নদী। এতে রয়েছে দস্তা, সীসা, তামা, নিকেল এবং ক্রোমিয়ামের মতো দূষক ধাতু। মাতানযা-রিয়াকুয়েলো নদীর অববাহিকার সুপেয় পানিকে দূষিত করছে এই দূষণ এবং এ প্রক্রিয়ায় ক্ষতি করছে এখানকার ২০ হাজার বাসিন্দার।
নাইজার নদীর বদ্বীপ, নাইজেরিয়া
এই অঞ্চলে দূষণের ফলে ঠিক কি পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তা এখনও অজানা। আফ্রিকার এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনেকবারই তেল উপচে পানিতে পড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৬ থেকে ২০০১ সালের মাঝে। গত বছর এই বদ্বীপ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ মিলিয়ন ব্যরেল তেল নিষ্কাশন করা হয়।
নরিলস্ক, রাশিয়া
সাইবেরিয়ার একটি শিল্পনগরী হলো নরিলস্ক। এখান থেকে প্রতি বছর বাতাসে প্রায় ৫০০ টন নিকেল এবং কপার অক্সাইড এবং প্রায় ২ মিলিয়ন টন সালফার ডাই অক্সাইড মিশে যায়। এখানকার কারখানার কর্মীদের আয়ু সারা রাশিয়ার মানুষদের গড় আয়ুর চাইতে ১০ বছর কম।